মেঘ-বৃষ্টি আর রোদের মধ্যে সপ্তাহ গড়ালো শিক্ষক এবং ছাত্রদের আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে শিক্ষার্থীরা কোটা বিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করছে। তাদের আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটছে। আন্দোলনে তারা দাবি করেছে, সামনের দিনগুলোতে আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেবে। যেকোন মূল্যে তারা কোটাপ্রথা বাতিল করতে বদ্ধপরিকর। শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলে মনে করছে টানা চার মেয়াদে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগ। তবে এই আন্দোলন যাতে রাজনৈতিক ও সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে না পারে সেদিকে পর্যবেক্ষণ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলন জোড়ালো হয়ে উঠেছে এবং এই আন্দোলন আরও তীব্র হতে পারে এমন ধারণা করা হচ্ছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল হয়। এই কোটা বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবরোধের পর আন্দোলনকারীরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, এই আন্দোলন তাদের বাঁচা-মরার দাবি। অবসরের সময় তারা যেন একটি নিশ্চিন্ত জীবন পান সেজন্যই তারা পূর্বের পেনশন স্কিমের ভেতর থাকতে চাইছেন। নতুন পেনশন স্কিমের যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তা তারা গ্রহণ করতে রাজি নন। শুধু তাই নয়, এটি তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেয়ার সামিল। তবে এই আন্দোলনগুলো শিক্ষাঙ্গনে অচলাবস্থা তৈরি করলেও এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনকে গুরুত্ব দিতে রাজি নয়। বরং আওয়ামী লীগ মনে করছে যে, এই আন্দোলন এমনিতেই থেমে যাবে। সরকার বিভিন্ন রকম কৌশল অবলম্বন করে আন্দোলনকে দুর্বল করে দিতে পারবে বলে মনে করছে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এটি আদালতের বিষয়। আদালতের মাধ্যমে যা ফয়সালা হবে সেটি সরকার মেনে নেবে। সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলছেন যে, আমরা কোটা প্রথা বাতিল করেছিলাম। কিন্তু হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনরায় চালু করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। এটি আদালতের বিষয়। কাজেই আদালতের বিষয় সরকারের কিছু করণীয় নেই। সরকার মনে করছে, আস্তে আস্তে কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে এবং বিষয়টি নিয়ে আদালতের মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তাই এই আন্দোলনকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলেই মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। তবে বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতা কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক নানা রকম বৈঠক করছেন। বিষয়গুলো তাদেরকে বোঝাচ্ছেন এবং আদালতের মাধ্যমে যেন বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে সমাধান হয় সে ব্যাপারে তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য স্বীকার করেছেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত। অন্যদিকে পেনশন বিরোধী শিক্ষকদের আন্দোলনকে তারা স্রেফ একটি আবেগ মনে করছেন। শিক্ষকরা যুক্তির বাইরে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়েই এই আন্দোলনে জড়িত হচ্ছেন। শিগগিরই তাদের ভুল ভাঙবে এবং তারা ফিরে আসবেন বলেও মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা শিক্ষকদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা এবং যোগাযোগ শুরু করেছেন। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিচ্ছেন তাদের চাবি সরকারের হাতে। সরকারপন্থী শিক্ষকরা এই আন্দোলনের মূল নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কাজেই সরকার মনে করে, আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলতে পারে বা আওয়ামী লীগ কোনো সংকটে পড়ে এরকম কোন ঝুঁকি শিক্ষক নেতৃবৃন্দ নেবেন না। শিক্ষক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইতোমধ্যেই অনানুষ্ঠানিকভাবে একাধিক বৈঠক হয়েছে এবং আন্দোলন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে যাবে। তবে সরকার পর্যায়ক্রমে সব সরকারি কর্মকর্তার জন্য নতুন পেনশন স্কিম চালু করবে বলে জানিয়েছেন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এখান থেকে সরে আসার কোনও পথ নেই। বরং এই পেনশন স্কিম কে আধুনিক এবং যুগোপযোগী হিসেবে অভিহিত করছে সরকার। আর এই বাস্তবতায় শিক্ষকদের আন্দোলন বেশিদূর এগোবে না বলে অনেকে মনে করছেন। ইতোমধ্যে দুই-একজন শিক্ষক এক পেনশন স্কিমের পক্ষে তাদের অবস্থান গ্রহণ করতে শুরু করেছে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ এই আন্দোলনের একটি স্তিমিত ভাব লক্ষ্য করা যাবে বলেও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের ধারণা। আর তাই এ দু’টি আন্দোলনের কোনটিকেই গুরুত্ব দিয়ে উদ্বিগ্ন হতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপির কাজ হচ্ছে অন্যের ওপর ভর করবে। এখন তারা কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর বেইলি রোডে পাহাড়ি ফলমেলা-২০২৪ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য তারা আইনী লড়াইয়ে পারেনি, পারেনি রাজপথে একটা আন্দোলন করতে। এখন বিএনপির কাজ হচ্ছে অন্যের ওপর ভর করবে। এখন তারা কোটা আন্দোলনের ওপর ভর করছে। অথচ কোটা পুরোটাই আদালতের ব্যাপার। সরকার এখানে কি করবে। এরআগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বৃহস্পতিবার শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বসার কথা ছিলো। কিন্তু ওবায়দুল কাদের রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে বৈঠকটি হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। তবে শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিম বাতিলের এই আন্দোলন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আরও তীব্র করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামীতে আরও কর্মসূচি আসতে পারে। তবে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের এই আন্দোলন যাতে অন্যদিকে প্রবাহিত না হয় বা সরকারর বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হতে না পারে সে ব্যাপারে সরকার সতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরাও এসব আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করছেন ও সতর্ক দৃষ্টি রেখেছেন।
সরকারি দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এ আন্দোলন পেশাজীবী আন্দোলন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এখানে যে সব দাবি রয়েছে সেগুলো পেশা সংশ্লিষ্ট। এটা কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। শিক্ষার্থীরা যে কোটা বাতিলের দাবি করছে সেটা এখন আদালতের রায়ের উপর নির্ভর করছে। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিয়ে কোটা বাতিল করে। কিন্তু উচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন সেখানে সরকারের কিছু করার নেই। রাষ্ট্র পক্ষ আবেদন করেছে আদালত কি রায় দেন সে পর্যন্ত সরকারকে অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন হলেও সরকার ও আওয়ামী লীগ বিষয়টির উপর দৃষ্টি রাখছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যাতে কোনো ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যে কোনো আন্দোলনেরই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। আন্দোলনের গতি প্রকৃতি অন্যদিকে ঘুরিয়ে সেটাকে রাজনৈতিক বা সরকারবিরোধী রূপ দেয়ার চেষ্টাও থাকতে পারে। তবে এই আন্দোলন অতদূর গড়ানোর সম্ভাবনা নেই। শিক্ষাদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ আছে। আদালতের রায়ের পর ছাত্র আন্দোলনও থেমে যাবে। কারণ আদালতের রায়ই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করছে, যেখানে আদালতের রায় রয়েছে সেখানে সরকারের তো কিছু করার নেই। শিক্ষকদের আন্দোলন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এ আন্দোলন তো কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, পেশা সংশ্লিষ্ট আন্দোলন। বসলে সমাধান বেরিয়ে আসবে বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, সরকার তো কোটা বাতিল করেছিলো। এখন আদালতের রায় তো সবারই মানতে হবে। তারপরও আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্ত কি আসে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তারপর আলোচনাও করা যেতে পারে। শিক্ষকদের বিষয়টিও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে উদ্বেলিত, উচ্ছ্বসিত, তীর্যক ভাষায় কথা বলার কিছু নেই। একটি শ্রেণী ঘোলা জলে মাছ ধরার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা সব সময়ই করে। তবে এই সব আন্দোলন নিয়ে সেই সুযোগ পাবে না, এ ব্যাপারে সরকার, আওয়ামী লীগ সতর্ক আছে। একইসুরে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সবুর। তিনি বলেন, যেকোনো আন্দোলনে সঠিকপথে এগোলে বাঁধা নেই। তবে আন্দোলনের নামে কেউ জনগণের জানমালের ক্ষতিসাধন করলে ছাড় পাবে না।

ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনে উদ্বিগ্ন নয় সতর্ক আ’লীগ
- আপলোড সময় : ০৭-০৭-২০২৪ ০৬:৪৫:২৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-০৭-২০২৪ ০৬:৪৫:২৭ অপরাহ্ন


নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ